কিশোরগঞ্জ, বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক এক জেলা, যার শেকড় হাজার বছরের পুরনো। ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত এই জেলা তার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আলোচিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রুচিশীল স্থানীয় খাবার এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের জন্য বিশেষ পরিচি্তি পেয়েছে। কিশোরগঞ্জের সমতল ভূমির অনেকাংশই হাওর অঞ্চল, নদ-নদী, এবং প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান দ্বারা বেষ্টিত। যার জন্য এই জেলার নাম অনেক আগে থেকেই মানুষের কাছে খুবই পরিচিত।
কিশোরগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত, এই জেলাটি ঢাকা বিভাগের একটি অংশ। জেলাটির মোট আয়তন প্রায় ২,৬৮৮.৫৯ বর্গকিলোমিটার, এবং জনসংখ্যা প্রায় ৩৭ লক্ষের মতো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই জেলা বিভিন্ন নদ-নদী যেমন ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কালভার এবং ভৈরব মেঘনা নদী এসব দ্বারা বেষ্টিত। জেলাটির উত্তর-পূর্বে ময়মনসিংহ, উত্তর-পশ্চিমে নেত্রকোনা, দক্ষিণ-পশ্চিমে নরসিংদী, পশ্চিমে গাজিপুর, দক্ষিণ-পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সুনামগঞ্জ জেলাসমূহ এই অঞ্চলের প্রতিবেশী।
কিশোরগঞ্জ জেলার নামকরণ ও তার ইতিহাস
কিশোরগঞ্জ জেলার নামকরণ কিভাবে হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মত। সর্বাধিক প্রচলিত মত অনুসারে, কিশোর
ঞ্জ জেলাটির নামকরণ হয়েছে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে বসবাস করা নন্দকিশোর প্রামাণিকের নামানুসারে। এই নন্দকিশোর প্রামাণিক, কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের পুত্র, যিনি ব্রহ্মপুত্র মতান্তরে নরসুন্ধা নদের তীরে একটি গঞ্জ বা বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে গঞ্জের নাম ছিল ‘কিশোরগঞ্জ’, যা পরবর্তী কালক্রমে সারা দেশের মধ্যে পরিচিতি লাভ করে।
অন্য আরেকটি মত অনুসারে, “কিশোর” শব্দের অর্থ যুবক বা তরুণ। ৬ষ্ঠ শতাব্দীরও পূর্বে এই আঞ্চলে লম্বা সময় ধরে মেয়ে সন্তানের তুলনায় প্রচুর পরিমাণ ছেলে সন্তান জন্ম নেয় এবং একসময় তারা পরিণত বয়সে পৌছলে যুবক বা কিশোরের সংখ্যা আশপাশের অঞ্চল থেকে এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। কথিত আছে, বিভিন্ন অঞ্চলের বণিকরা যখন এই অঞ্চলে আসতো তখন হাট-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে যেখানেই যেতো সেখানেই কিশোরদের উপস্থিতি অন্য সব হাট থেকে বেশি পরিমাণ দেখতে পেতেন। পবর্তীতে এই অঞ্চলে ব্যবসার কাজে আসার সময় কোন বণিক “কোথায় যাচ্ছেন?” এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে বণিকরা মজাচ্ছলে উত্র দিতেন কিশোরের গঞ্জে যাচ্ছি। বণিকদের এমন হাস্যরসাত্মক উত্তরই এক সময় এই অঞ্চলের নামে পরিণত হয়। কিশোরের গঞ্জ থেকে কালের বিবর্তনে এই অঞ্চলের নাম রাখা হয় “কিশোরগঞ্জ”।
কিশোরগঞ্জের আদি ইতিহাস
কিশোরগঞ্জের রজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলটিতে পাল, বর্মণ এবং সেন রাজবংশের অধীনের রাজত্ব্য ছিল। সে সময় কিশোরগঞ্জ অঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। ১৪৯১ সালে ময়মনসিংহের অধিকাংশ অংশ মুসলিম শাসক ফিরোজ শাহ-এর অধীনে থাকলেও কিশোরগঞ্জ ছিল মুসলিম শাসনের বাইরে।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের শাসনভার গ্রহণ করলে ১৭৬৬ সালে কিশোরগঞ্জকে ময়মনসিংহ জেলার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর আগে কিশোরগঞ্জ আলাদা অঞ্চল হিসেবেই পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময় ১৮৩১ সালে কিশোরগঞ্জকে একটি মহকুমা হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৮৪ সালে কিশোরগঞ্জকে জেলা হিসেবে গঠন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কিশোরগঞ্জের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ স্বাধীনতা লাভ করে।
কিশোরগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও হাওর
কিশোরগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হাওরের কারণে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। জেলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চল, যা বাংলাদেশের কৃষিপণ্য উৎপাদনের অন্যতম প্রধান জায়গা। কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মধ্যে হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, ইটনা হাওর এবং নিকলী হাওর উল্লেখযোগ্য। কিশোরগঞ্জের এসব হাওর মাছ, ধান, পাট এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর হিসেবে পরিচিত, যার আয়তন প্রায় ২০,৪০০ হেক্টর। এই হাওরে একাধিক মাছের প্রজাতি রয়েছে এবং মৎস্য উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবেও এর বেশ সুনাম রয়েছে। এই হাওর কিশোরগঞ্জের সিলেট পার্শবর্তী এলাকার পাশে অবস্থিত। অপরদিকে, টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাওর, যা কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলাস্থ স্থানে অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ৯,৭২৭ হেক্টর এবং এই হাওরে ৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খাবার
কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ এবং বৈচিত্র্য স্থানীয়দের পাশাপাশি আশপাশের জেলা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। জেলাটির বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে:
চ্যাপা: এটি একটি মুখরোচক খাবার, যা শুঁটকি মাছেরই আরেকটি সংরক্ষণ পদ্ধতি। এই চ্যাপা কাঁচামরিচের সাথে সিদ্ধ করে ভর্তা করা হয়। স্থানিয় ভাষায় এটিকে “শিদল ভর্তা” বলা হয়ে থাকে।
এই শিদল রসুন ও মরিচের সাথে বেটে কচুপাতা বা লাউ পাতা দিয়ে মোড়িয়ে তেলে ভেজে আরেকটি মুখরোচক খাবার তৈরি করা হয়। কিশোরগঞ্জে এই খাবারটি খুবই জনপ্রিয়।
কালাই ডাল: একটি সুস্বাদু রান্না, যা কালাই, মসলা এবং মাছ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়।
মৈশালি: একটি পুষ্টিকর খাবার যা আলু, ডাল, সবজি, মাছ এবং মাংস দিয়ে তৈরি হয়।
কিশোরগঞ্জের রসগোল্লা: এটি একটি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন যা ছানা, চিনি, দুধ ও মসলার মিশ্রণে তৈরি হয় এবং স্বাদে অনন্য।
অষ্টগ্রামের পনির: এটি কিশোরগঞ্জ সহ সারাদেশে খুবই জনপ্রিয়। দুধ দিয়ে তৈরি এই পনির দিয়ে চিজ বানানো সহ বিভিন্ন খাবারে ব্যবহার করা হয়।
কিশোরগঞ্জের দর্শনীয় স্থান
কিশোরগঞ্জের এত সুনামের পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলো। পর্যটকদের মূল আকর্ষণের কেন্দ্র থাকে এখানকার দর্শনীয় স্থান। এরমধ্যে,
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান: যেটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈদগাহ ময়দান। যেখানে একসাথে কয়েক লাখ মানুষ ঈদের নামাজ আদায় করতে পারে। শোলাকিয়া ঈদ্গাহ ময়দান জেলা শহরের পাশেই অবস্থিত।
জঙ্গলবাড়ি দুর্গ: এটি বাংলার বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর প্রাচীন বাসস্থান ছিল। যা এখনও নিদর্শন হিসেবে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে রেখেছে।
শহীদী মসজিদ: শহরের প্রণকেন্দ্রে অবস্থিত মসজিদটি ১৭৮৮ সালে নির্মিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা স্থানীয় মুসল্লিদের কাছে খুবই প্রিয়। এই মসজিদটির পাশেই রয়েছে জেলা পাবলিক লাইব্রেরি এবং ঐতিহাসিক দ্বীনি মার্কায “জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ”।
নরসুন্দা লেকসিটি: আনন্দঘন মুহুর্ত কাটানোর জন্য কিশোরগঞ্জ শহরের এই লেকটির বিকল্প হয়তো নেই। এই লেককে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে মুক্তমঞ্চ যা কিশোরগঞ্জ “গুরুদয়াল সরকারি কলেজ” এর পাশে অবস্থিত। সেখানকার সু-উচ্চ ওয়াচ টাওয়ার নরসুন্দা লেক ও মুক্তমঞ্চের সৌন্দর্যকে আরো দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে। এটি কিশোরগঞ্জের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কবী চন্দ্রবতীর বাড়ী: এটি কিশোরগঞ্জ শহর হতে ৭ কিলোমিটার দূরে নীলগঞ্জে অবস্থিত। চন্দ্রবতী উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কবি । যিনি কিশোরগঞ্জের সন্তান হয়ে বাংলা সাহিত্যে বড় অবদান রেখেছেন। তার এলাকার নাম আগে অন্য একটি থাকলেও পরবর্তীতে তার নামে নাম করণ করে ওই গ্রামের নামও চন্দ্রবতী নামে রাখা হয়। সেখানে তিনি যে মন্দিরে পূজা দিতেন সেই মন্দিরটি রয়েছে এবং তিনি যে বাড়িটিতে বসবাস করতেন সেই বাড়িটিও রয়েছে। রয়েছে পুরোনো বাড়ি ও সে বাড়ির নিদর্শন।
কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব
কিশোরগঞ্জের সুনাম দেশব্যাপী ছড়ানোর মূল কারণ এখানে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। তাদের মধ্যে:
কবি চন্দ্রবতী : যিনি ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কবি।
কবি দ্বিজ বংশীদাস: বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, যিনি মনসামঙ্গল কাব্যের রচনা করেছেন।
উপেন্দ্র কিশোর রায়: শিশু সাহিত্যিক, যিনি বহু জনপ্রিয় শিশু কাব্য রচনা করেছেন।
শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম: মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
মরহুম জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কিশোরগঞ্জ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বা ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং এই জেলার সাংস্কৃতিক ও খাদ্য ঐতিহ্যও সারা দেশে সমান ভাবে সমাদৃত। এখানকার হাওর, ইতিহাস, দর্শনীয় স্থান এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা কিশোরগঞ্জকে বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঘুরার জন্য হতে পারে কিশোরগঞ্জ একটি ভালো জায়গা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন