ঢাকা, ৫ মার্চ – বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু শেখ হাসিনা নন, তার পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বুধবার (৫ মার্চ) প্রকাশিত স্কাই নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গণহত্যার অভিযোগের মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমনে তার সরকারের কঠোর পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
গণআন্দোলনের চাপে পড়ে ২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারান এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তার বিদায়ের পর ধীরে ধীরে উঠে আসছে ভয়াবহ নির্যাতন, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন চিত্র।
ড. ইউনূস অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে গোপন আটক কেন্দ্রগুলোর নেটওয়ার্ক পরিচালিত হয়েছে, যেখানে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের আটক রেখে নির্যাতন চালানো হতো। এমনকি অনেককে হত্যা করা হয়েছে, যা "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ব্যানারের আড়ালে পরিচালিত হতো।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস জানান, ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানানো হয়েছে, তবে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, "বিচার অবশ্যই হবে— সেটা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেও হতে পারে, আবার তার অনুপস্থিতিতেও হতে পারে।"
সম্প্রতি "হাউস অব মিররস" নামে পরিচিত একটি কুখ্যাত গোপন কারাগার পরিদর্শন করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, "এটি এমন এক ভয়ংকর স্থান, যা প্রত্যক্ষ করা সত্যিই হৃদয়বিদারক।"
প্রফেসর ইউনূস জানান, পুরো সরকারব্যবস্থা অপরাধে জড়িত থাকায় দায়ীদের শনাক্ত করতে কিছুটা সময় লাগছে। তিনি বলেন, "এখানে অনেক স্তরের জড়িত লোকজন রয়েছে— কেউ আদেশ দিয়েছে, কেউ তা পালন করেছে, কেউ প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে। তাই এই বিচার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। তবে অপরাধীরা শাস্তি পাবেই।"
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক দমন-পীড়নে হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদনে বলা হয়, তার বিপুল সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মূলত, দুর্নীতির অভিযোগে নাম জড়ানোর পর টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ সরকারের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে রোহিঙ্গা সংকটও ভয়াবহ রূপ নেয়। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংকট নিরসনে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে। ড. ইউনূস জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। মাদক চোরাচালান ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর আধিপত্যের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। ড. ইউনূস আশাবাদী যে, এর আগেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হবে এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে।
তিনি বলেন, "কিছু অপরাধীর বিচার দ্রুত হবে, কিছু সময়সাপেক্ষ হতে পারে। তবে ন্যায়বিচারের দাবির সামনে কেউই পার পাবে না।"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন