রংপুরে ছাত্র আন্দোলনে গুলিচালনার মামলায় ব্যবসায়ী লিপি খান ভরসা গ্রেফতার

রংপুরে ছাত্র আন্দোলনে গুলিচালনার মামলায় ব্যবসায়ী লিপি খান ভরসা গ্রেফতার

রংপুর মহানগরীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র বিক্ষোভে হামলা ও গুলিচালনার ঘটনায় হত্যাচেষ্টার মামলার ১৭৯তম আসামি ব্যবসায়ী লিপি খান ভরসাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। রোববার (১৬ মার্চ) সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর গুলশান থেকে তাকে আটক করা হয়। রংপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাকে রংপুরে এনে আদালতে হাজির করা হবে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।


মামলার এজাহার অনুযায়ী, গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে রংপুর সিটি বাজারের সামনে বৈষম্যের বিরুদ্ধে মিছিল নিয়ে জড়ো হওয়া ছাত্রদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুলি চালায়। ওই হামলায় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাটির তদন্তে গত ১৩ নভেম্বর রংপুর কোতোয়ালি থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করেন গুলিবিদ্ধ এক শিক্ষার্থী মামুনুর রশিদ মামুন। এ মামলায় মোট ১৭৯ জনকে আসামি করা হয়, যাদের মধ্যে লিপি খান ভরসা সর্বশেষ তালিকাভুক্ত হন।

ওসি আতাউর রহমান জানান, "দীর্ঘদিন ধরে লিপি খান ভরসার অবস্থান শনাক্ত করতে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো হচ্ছিল। গুলশানে তার আত্মগোপনের খবর পেয়ে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়।" বর্তমানে তাকে গুলশান থানায় আটক রেখে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে তিনি যোগ করেন।


স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জুলাই মাসে রংপুরে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তি প্রক্রিয়ায় "অঞ্চলভিত্তিক কোটা" বাতিলের দাবিতে ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় নগরীর গ্র্যান্ড হোটেল মোড় থেকে বিক্ষোভকারীরা সিটি বাজারের দিকে মিছিল নিয়ে এগোলে পুলিশ তাদের রাস্তা অবরোধ করে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের একদল নেতাকর্মী অস্ত্রসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় মামুনুর রশিদসহ কয়েকজন তরুণ গুরুতর আহত হন। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মামুনুর রশিদ মামলাটি দায়ের করেন।

লিপি খান ভরসা রংপুরের পরিচিত ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী হিসেবে খ্যাত। স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, হামলার দিন তিনি সশস্ত্র নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন এবং পুলিশকে বিক্ষোভ দমনে প্ররোচিত করেন। তবে তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, লিপি খান নির্দোষ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন।


এই গ্রেফতারের ঘটনায় রংপুরের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্র অধিকার সংগঠন "সাম্য ছাত্র ঐক্য"-এর সমন্বয়ক আরিফুল ইসলাম বলেন, "শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে গুলি চালানোর ঘটনায় দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। লিপির গ্রেফতার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে বাকি আসামিদের দ্রুত শনাস্তি চাই।" অন্যদিকে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল আলম বলেন, "মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের দলের কেউই সেদিন গুলি চালায়নি।"


পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, লিপি খান ভরসাকে রংপুরে স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। আদালতে তাকে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হতে পারে। আইনজীবী এডভোকেট সৈয়দ মো. রাকিবুল হক বলেন, "হত্যাচেষ্টার মামলায় সাজা পেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। তবে অভিযোগ প্রমাণে স্বাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করা জরুরি।"

এদিকে, মানবাধিকার সংগঠন "নিরাপদ রংপুর"-এর সমন্বয়ক ফারহানা আক্তার বলেন, "রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া তদন্ত হলে ন্যায়বিচার পাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। আমরা আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা রাখি।"


বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা ও গুলিচালনার বেশ কয়েকটি ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে রংপুর বিভাগে রাজনৈতিক সহিংসতার ৭২টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার ৬০%ই শিক্ষার্থী বা যুবকদের বিক্ষোভের সাথে সম্পর্কিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিরোধী দলের ভোটার দমনে এ ধরনের হামলা একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

মামলার বাদী মামুনুর রশিদের পরিবার জানায়, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত। তার বাবা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, "আমার ছেলে আজও হাঁটতে পারে না। আমরা শুধু চাই, যারা এ অপরাধ করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।"


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন