
বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনামে উঠে এসেছে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় হামাসের চার উচ্চপদস্থ নেতা নিহতের মর্মান্তিক ঘটনা। স্থানীয় সময় সোমবার (১৭ মার্চ) মধ্যরাতে সংঘটিত এই হামলায় গাজা প্রশাসনের কার্যত প্রধানমন্ত্রী ইশাম দা-আলিসসহ হামাসের তিন শীর্ষ মন্ত্রী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সরাসরি এ হামলার দায় স্বীকার করে বলেছে, "হামাসের সামরিক ও বেসামরিক কাঠামোকে ধ্বংস করাই এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল।" গত কয়েক মাসে এটিই হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সফলতা বলে মনে করা হচ্ছে।
টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান বাহজাত আবু সুলতানের বাসভবনে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় সেখানে হামাস সরকারের বিচার মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক আহমেদ আল-খাত্তা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আবু ওয়াতফাও উপস্থিত ছিলেন। একই সময় গাজা সিটির আল-রিমাল এলাকায় হামাসের কার্যত প্রধানমন্ত্রী ইশাম দা-আলিসের গোপন অবস্থান চিহ্নিত করে সেখানে বিমান হামলা চালায় আইডিএফ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হামলার পর থেকে গাজাজুড়ে হামাসের নেতৃত্বে চলছে জরুরি বৈঠক।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেটের তথ্যের ভিত্তিতে এ হামলা পরিচালিত হয়েছে বলে দাবি আইডিএফ-এর। তাদের বক্তব্য, "এই নেতারা হামাসের বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক অপারেশন সমন্বয়ের মূল চাবিকাঠি ছিলেন। তাদের অপসারণের মাধ্যমে গাজায় হামাসের নেটওয়ার্ক দুর্বল হবে।" গত বছরের জুলাইতে হামাসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাহি মুস্তাহাকে হত্যার পর ইশাম দা-আলিসকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। মাত্র ৮ মাসের মাথায় তার মৃত্যু হামাসের রাজনৈতিক কাঠামোয় নতুন সংকট তৈরি করেছে।
ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসিত সরকারের পক্ষ থেকে এ হামলাকে "যুদ্ধাপরাধ" ও "রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড" বলে নিন্দা জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন গাজায় বেসামরিক নেতাদের টার্গেট করাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সরাসরি প্রতিক্রিয়া আসেনি, যা ফিলিস্তিনি সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
হামলার পর গাজায় হামাসের পক্ষ থেকে ৩ দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রমাগত নেতৃত্বশূন্যতা ও অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা প্রায় অচল। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত এক বছরে ইসরায়েলি হামলায় ২৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪৭ জন নারী ও শিশু। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজার ৮০% জনগণ মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল, যা সাম্প্রতিক হামলার পর আরও সংকটাপন্ন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ড. তারিক রহমানের মতে, "ইসরায়েল হামাসের বেসামরিক নেতৃত্বকে টার্গেট করে তাদের প্রশাসনিক কাঠামোকে ধ্বংস করতে চাইছে। কিন্তু এ কৌশল দীর্ঘমেয়াদে শান্তি আনবে না, বরং নতুন করে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেবে।" অন্যদিকে, তেল আভিভভিত্তিক কৌশলগত গবেষক অ্যামির কোহেন বলেছেন, "হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা না করে শুধু সামরিক চাপ প্রয়োগ করা ইসরায়েলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।"
গাজায় হামাসের পরবর্তী নেতৃত্ব কে হবেন, তা এখনো অনিশ্চিত। ফিলিস্তিনি সূত্রে খবর, হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জুদ্দিন আল-কাসাম ব্রিগেডের কমান্ডাররা জরুরি বৈঠক করেছেন। ইরান ও কাতারের মতো দেশগুলো হামাসকে সমর্থন জোরদার করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ দল হামাসের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন