ফেনী সদর উপজেলার দক্ষিণ গোবিন্দপুর এলাকায় যৌতুকের টাকা দিতে না পারার অভিযোগে নববধূ মারজান আক্তার ঝুমুরকে (১৯) স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের মারধরে হত্যার মর্মান্তিক ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। ঝুমুর গত শনিবার (১৫ মার্চ) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার শ্বশুর সাহাব উদ্দিনকে (৫২) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে স্বামী সাইদুর রহমান তৌহিদ (২৬) ঘটনার পরপরই দেশ ছেড়ে প্রবাসে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।ঝুমুরের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৮ ডিসেম্বর ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আলমপুর গ্রামের ঝুমুরের সঙ্গে দক্ষিণ গোবিন্দপুরের প্রবাসী সাইদুর রহমান তৌহিদের মোবাইল কোর্টে বিয়ে হয়। পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি তৌহিদ দেশে ফিরে বড় আয়োজনে বিয়ের রীতি সম্পন্ন করেন। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে ঝুমুরের পরিবারের কাছে ৩ লাখ টাকা নগদ ও ৫ ভরি স্বর্ণের যৌতুক দাবি করা হয়। ঝুমুরের বাবা আবদুল আলিম (৫০) একজন নির্মাণ শ্রমিক হওয়ায় এই দাবি পূরণ তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
ঝুমুরের মা ফরিদা আক্তার (৪৫) জানান, গত ৪ মার্চ সাইদুর, শ্বশুর সাহাব উদ্দিন ও শাশুড়ি বিবি হাজেরা (৪৮) যৌথভাবে ঝুমুরকে লাঠি ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়। ১২ দিন আইসিইউতে লড়াইয়ের পর শনিবার সকালে তার মৃত্যু হয়।
ঝুমুরের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, "হাসপাতালে গিয়ে মেয়ের গায়ে জ্বলন্ত ইস্ত্রি দাগ, ভাঙা হাড়ের ছবি দেখেছি। ওরা জানোয়ার... আমার মেয়েকে হত্যা করেছে।" তিনি আরও যোগ করেন, "১২ মার্চ ঝুমুরের মুখ থেকে নির্যাতনের কথা শুনে ফেনী মডেল থানায় স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে মামলা করি। এখন শুধু বিচার চাই।"
ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শামছুজ্জামান নিশ্চিত করেছেন, ঝুমুরের মৃত্যুর পর থেকেই তদন্ত জোরদার করা হয়। শনিবার রাতেই শ্বশুর সাহাব উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে স্বামী তৌহিদ বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। ওসি বলেন, "আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে স্বামীকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শাশুড়ি হাজেরাও আত্মগোপনে রয়েছেন—তাদের খুঁজছি আমরা।"
বাংলাদেশে যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়লেও এর প্রতিকার এখনও অধরাই রয়ে গেছে। জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, গত বছর যৌতুকের কারণে ১,২১৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার ২৮%ই নববধূ। ফেনীর এই ঘটনাটি আবারও প্রশ্ন তুলেছে সামাজিক সচেতনতা, আইনের প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে।
মানবাধিকার কর্মী অধ্যাপিকা ড. নাসরিন আহমেদ বলেন, "যৌতুক প্রতিরোধ আইন ২০১৮ আছে, কিন্তু অভিযোগ দায়েরের পর অভিযুক্তদের দ্রুত বিচার হয় না। পুলিশ-প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে।"
ঝুমুরের বাবা আবদুল আলিম দিনমজুর হিসেবে মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয় করেন। তিনি বলেন, "মেয়ের বিয়েতে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এখন ওই ঋণ শোধ করতে গেলেও যৌতুক দেব কোথায়? মেয়েটাকেও হারালাম..." স্থানীয়রা জানান, ঝুমুরের পরিবারকে সামাজিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
ঝুমুর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জাহিদ হাসান বলেন, "মেডিকেল রিপোর্ট, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও সাক্ষী বিবৃতি সংগ্রহ করা হয়েছে। হত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করা হবে।" আইনজীবী এডভোকেট সেলিনা আক্তার বলেন, "নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ধারা ১১(ঘ) অনুযায়ী এই মামলায় মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।"
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, "এলাকায় যৌতুকবিরোধী ক্যাম্পেইন বাড়াবো। ঝুমুরের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রশাসন।" তবে স্থানীয় যুব সমাজের নেতা রফিকুল ইসলামের মতে, "গ্রাম্য সালিশে যৌতুকের দাবিকে বৈধতা দেওয়া হয়—এই মানসিকতা বদলাতে হবে।"
ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। টুইটারে #JusticeForJhumur হ্যাশট্যাগে ব্যবহারকারীরা দ্রুত বিচার ও যৌতুক ব্যবস্থার উচ্ছেদ চাইছেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঝুমুরের পরিবারকে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন