দেশের প্রায় ৮ হাজার দাখিল ও আলিম মাদ্রাসায় ক্রমাগত কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। গত এক দশকে দাখিল (এসএসসি) পাস করা শিক্ষার্থীদের মাত্র ৩৮% আলিম (এইচএসসি) পর্যায়ে ভর্তি হচ্ছেন, বাকি ৬২% পাড়ি জমাচ্ছেন সাধারণ কলেজ বা কারিগরি প্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে এ চিত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার সীমিত বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির অস্পষ্ট নীতিমালা এবং কর্মমুখী দক্ষতার অভাবই এ সংকটের মূল কারণ।বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে দাখিল পরীক্ষায় ২ লাখ ২৮ হাজার ৪১০ জন উত্তীর্ণ হলেও আলিমে নিবন্ধন করেন মাত্র ৮৮ হাজার ৩০২ জন (৩৮%)। একই প্রবণতা দেখা গেছে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে দাখিল পাসের পর আলিমে ভর্তি হন ৩৪.৮% (৮৮,৫৩৯ জন), ২০১৮ সালে ৩৭% (১ লাখ ১৩৬ জন), এবং ২০১৭ সালে ৩৮% (৯৯,৩২০ জন)। ২০১৬ সালে এ হার ছিল নিম্নতম ৩৪.২% (৭৪,৫৬১ জন)।
কেন ছাড়ছেন মাদ্রাসা? শিক্ষার্থীদের জবানিতে চার কারণ
১. বিজ্ঞান শিক্ষার অপ্রতুলতা: দাখিল পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও আলিমে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গণিত একসাথে পড়ার সুযোগ সীমিত। ২০১১ সালে দাখিল পাস করা আবুল কালাম (ছদ্মনাম) বলেন, "আলিমে বিজ্ঞান নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া অন্য বিভাগে ভর্তির সুযোগ ছিল না। এখনও অনেক মাদ্রাসায় কোয়ালিফাইড বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব।"
২. বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির বাধা: আগে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন, অর্থনীতি বা সমাজবিজ্ঞানে ভর্তির সুযোগ সীমিত ছিল। বাংলা ও ইংরেজিতে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা (২০০ নম্বরের পরিবর্তে) তাদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিত।
৩. সামাজিক স্বীকৃতির সংকট: নোয়াখালীর কাউসার উদ্দিনের ভাষ্য, "মাদ্রাসার সার্টিফিকেট নিয়ে পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করতাম। সাধারণ শিক্ষার ডিগ্রি চাকরির বাজারে বেশি গ্রহণযোগ্য।"
৪. কারিগরি শিক্ষার প্রতি ঝোঁক: পলিটেকনিক বা ভোকেশনাল প্রশিক্ষণে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ায় অনেকেই মাদ্রাসা ছেড়ে যাচ্ছেন।
মাদ্রাসা বোর্ডের প্রতিক্রিয়া: কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মিঞা মো. নূরুল হক বলেন, "মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ জোরদার করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২,৭৩১টি দাখিল ও ৫৩৮টি আলিম মাদ্রাসায় বিজ্ঞান শাখা চালু হয়েছে।" তিনি আরও যোগ করেন, "শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে কোটা সংস্কার নিয়ে কাজ চলছে।"
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট মাহফুজ মুর্শেদ স্বীকার করেন, "৬২% মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও ৮০% প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত ল্যাব বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই।"
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ড. ফারহানা করিমের মতে, "মাদ্রাসা শিক্ষাকে টেকসই করতে হলে কারিকুলামে ইংরেজি, আইসিটি ও বাজার-ভিত্তিক বিষয় যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বা অনুষদ তৈরি করা জরুরি।"
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কাউসার উদ্দিন প্রমাণ করেছেন, মাদ্রাসা থেকে উঠে এসেও সাফল্য সম্ভব। তিনি বলেন, "দাখিলের পর কলেজে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখিনি, কিন্তু নোবিপ্রবি থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন গবেষণায় যুক্ত হয়েছি।"
যদিও মাদ্রাসা বোর্ড দাবি করছে, ২০২৩ সালে আলিমে ভর্তির হার বেড়ে ৪২% হয়েছে, তবুও সাধারণ শিক্ষার সাথে সমন্বয়হীনতা রূপান্তরের প্রধান বাধা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে মাদ্রাসাগুলোতে "বিজনেস স্টাডিজ" বিভাগ চালু ও বৃত্তিমূলক কোর্স সংযোজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন